সত্য-মিথ্যা
Umarah Junnah Khan 16 March 2021 695 Last Updated : 10:20 AM 16 March 2021
সত্য-মিথ্যা:
নবীজী স এরশাদ করেন, "সত্য নাজাত দিবে, এবং মিথ্যা ধ্বংস করবে"। হাদীস।
♦আপনার হাত ফসকে যদি একটি গ্লাস পড়ে যায়, ভাঙ্গার বিশ্রী শব্দটি সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু কাঁচের টুকরোগুলি চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে; সেগুলির ওপর কেউ হাঁটলে তার পা কেটে যাবে।
একইভাবে, "আপনি যখন এমন কিছু বলেন যা অন্য কারও কোনো অনুভূতিতে আঘাত করে, বা আপনি শুনে কষ্ট পান; তখন কথাটি অদৃশ্য হয়ে যায় কিন্তু হৃদয়ে ব্যথাটি থেকে যায়।
অতএব, ভাল কথা ব্যতীত কিছু বলা উচিত নয় এবং কাউকে কিছু বলার আগে আল্লাহ তাআলা সূরা হুজুরাতে (শিষ্টাচারের সূরা) যে দশটি পরামর্শ ও নিষেধের কথা বলেছেন তা সর্বদা কথা বলার সময়, বক্তৃতা করার সময়ও মনে রাখি। আল্লাহ কি বলেছেন?
১। -فتبينوا:
"ফা তাবাইয়ানু": তদন্ত করুন। যখনই আমরা কোন তথ্য বা সংবাদ পাই, তা সত্যি না মিথ্যা তা বোঝার চেষ্টা করি, এমন না হয় আমার অজ্ঞতার কারণে মিথ্যা তথ্যটি লোকদের ক্ষতি করে দিলো। সোজা কথায় মিথ্যা গুজব না ছড়াই; মিথ্যা দাবী না করি।
২ -فأصلحوا:
"ফা আসলিহু": মীমাংসা করুন: সমস্ত বিশ্বাসী ও মুমিনরা ভাই ভাই, তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিতর্ক চললে তা মিটিয়ে দিই।
৩ -وأقسطوا:
"ওয়া আকছিতু": ন্যায়বিচার করুন: যখনই কোন বিরোধ নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করি উভয় বিবাদী পক্ষের মধ্যে ন্যায়-বিচার করি, কারণ আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা ন্যায়-বিচার করেন। বিচার বহির্ভুত একতরফা কোন কাজ না করি।
৪ -لا يسخر:
"লা ইয়াছখার": উপহাস করবেন না: -- অন্য মানুষকে নিয়ে হাসাহাসি না করি, টিটকারী না মারি। যাকে ছোট করছি আল্লাহর চোখে সে উত্তম হতে পারে।
৫ -- وَلَا نِسَآءٌ مِّن نِّسَآءٍ
ওয়ালা নিছাউম মিন নিছাইন।
কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে।
৬ - ولا تلمزوا:
"ওয়া লা তালমিঝু": অপমান করবেন না। কাউকে তুচ্ছ মনে করে তাকে গালাগালি আর অপমান না করি।
৭ -ولا تنابزوا:
"ওয়া লা তানাবাঝু": তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। আপত্তিজনক ভাবে নাম বদলে খারাপ উপাধির নামে ডাকবে না।
৮ -اجتنبو كثيرا من الظن:
"ইজতানিবু কাছিরান মিনাজ্জাননি": অন্যের সম্মন্ধে নেতিবাচক অনুমান ও ধারণা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো। অনুমান করে ধারণা করা পাপ।
৯ -ولا تجسسوا
"ওয়া লা তাজাছছাছু": একে অপরের গোপনীয় বিষয় নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করবে না।
১০ -ولا يغتب بعضكم بعضا:
"ওয়া লা ইয়াছতাব বা'দুকুম বা'দান": অন্যের ব্যক্তিগত দোষ খুঁজে বের করে কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। এটি আপন মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমতুল্য। আমরা কেউ তা পছন্দ করিনা। আল্লাহ বলেন, "আসলে তোমরা তো একে অপরকে ঘৃনাই করো।"
শেষে আল্লাহ বললেন, আল্লাহ্কে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
মানুষে মানুষে ঝগড়া, বিবাদ শত্রুতা বন্ধ হয়ে যেত যদি পৃথিবীর মানুষেরা, রাজনৈতিক নেতারা সূরা হুজুরাতে বর্ণিত আল্লাহর দশটি হুকুমকে মান্য করে চলতো
ইসলামের দৃষ্টিতে মিথ্যার পরিণতি
শফিকুল ইসলাম শফিক
মিথ্যা বলা ও মিথ্যাচার একটি জঘন্যতম অপরাধ এবং ঘৃণিত অভ্যাস। মিথ্যা বলার চেয়ে নিকৃষ্ট গুনা আর নেই। তাই মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। আল কোরআন ও হাদিসে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। নিচে মিথ্যা বলার বিধান এবং তার পরিণতি সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস উদ্ধৃত করা হলো।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৬)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে পথনির্দেশনা করে। আর মানুষ সত্য কথা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তাকে “মহা সত্যবাদী” রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর নিঃসন্দেহে মিথ্যাবাদিতা নির্লজ্জতা ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। আর পাপাচার জাহান্নামের দিক নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে তাকে “মহা মিথ্যাবাদী” রূপে লিপিবদ্ধ করা হয়।’ (বুখারি, মুসলিম)।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে খাঁটি মুনাফিক গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তির মাঝে তার মধ্য থেকে একটি স্বভাব থাকবে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থাকবে। সে স্বভাগুলো হলো— ১. তার কাছে আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। ২. সে কথা বললে মিথ্যা বলে। ৩. ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং ৪. ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষা বলে। (বুখারি, মুসলিম)।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন স্বপ্ন ব্যক্ত করল, যা সে দেখেনি। [কিয়ামতের দিনে] তাকে দুটি যবদানার মাঝে সংযোগ সাধন করতে আদেশ করা হবে; কিন্তু সে তা কস্মিনকালেও পারবে না। যে ব্যক্তি কোনো জনগোষ্ঠীর কথা শোনার জন্য কান পাতে, যা তারা আদৌ পছন্দ করে না, কিয়ামতের দিনে তার কানে গলিত সিসা ঢেলে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি কোনো [প্রাণীর] ছবি তৈরি করে, কিয়ামতের দিন তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদেশ করা হবে, অথচ সে তা করতে পারবে না।’ (বুখারি, মুসলিম)।
যাচাই-বাছাই ছাড়া সংবাদ প্রচার করা মিথ্যার শামিল : আবু হুরাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শোনে [বিনা বিচারে] তা-ই বর্ণনা করে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ)।
সামুরাই রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার তরফ থেকে কোনো হাদিস বর্ণনা করে অথচ সে জানে যে তা মিথ্যা, তবে সে দুই মিথ্যুকের একজন।’ (বুখারি, তিরমিজি)।
হাদিসের অপ ব্যাখ্যা করাও নবীজীর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়া।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাকো। (সূরা হজ, আয়াত ৩০)।
তিনি আরও বলেন, [তারাই পরম দয়াময়ের বান্দা] যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। (সূরা ফুরকান, আয়াত ৭২)।
আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের কি অতি মহাপাপের কথা বলে দেব না?’ আমরা বললাম, ‘অবশ্যই বলুন হে আল্লাহর রসুল।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরিক করা এবং মাতা-পিতার অবাধ্য আচরণ করা।’ তারপর তিনি হেলান ছেড়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, ‘শোনো! আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’ শেষোক্ত কথাটি তিনি বার বার বলতে থাকলেন। এমনকি অনুরূপ বলাতে আমরা [মনে মনে] বললাম, ‘যদি তিনি চুপ হতেন।’ (বুখারি, মুসলিম)।
জবানের হেফাজত করুন : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করুক না কেন তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তত্পর প্রহরী (ফেরেশতা) তার কাছেই রয়েছে।’ (সূরা কাফ, আয়াত ১৮)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী (জিহ্বা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী (লজ্জা) স্থানের জামানত দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হব।’ (বুখারি)।
রসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা কি জানো গীবত কী?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহ ও রসুলই অধিক অবগত।’ তিনি বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের অসাক্ষাতে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে।’ আরজ হলো, ‘আমার ভাইয়ের মধ্যে যদি সেই দোষ থাকে যা আমি বলি?’ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি যা বর্ণনা কর তা যদি সত্যিই তার মধ্যে থাকে, তবে এটাই গিবত। আর তার মধ্যে যদি সেই দোষ না থাকে তাহলে তো তুমি তাকে অপবাদ দিলে।’ (মুসলিম)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলমান ভাইকে তার তওবাকৃত অপবাদের কথা উল্লেখ করে লজ্জা দেবে, সে নিজে সেই পাপ না করা পর্যন্ত মরবে না। (তিরমিজি)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি চুপ থাকে সে নাজাত পায়।’ (তিরমিজি)।
লেখক : ইসলামী গবেষক।
মিথ্যা রটনা ও মানব হত্যার ভয়ংকর পরিণতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
সত্যতা ইমান ও ইসলাম
সত্যতা ও সততা ইসলামের মূল চালিকা শক্তি। মুমিন বা মুসলিম হলো সত্যের অনুসারী। জীবনের সব ক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় সত্যের অনুসরণ করাই হলো ইমান ও ইসলাম। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘তুমি বলো: সত্য এসেছে, মিথ্যা অপসৃত হয়েছে; নিশ্চয় মিথ্যা দূরীভূত হবেই’ (১৭: ৮১)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে সংমিশ্রণ করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না’ (২: ৪২)।
সংবাদ যাচাই জরুরি
সঠিক তথ্য বা সংবাদ জ্ঞানের উৎস। তাই কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন। কারণ, ভুল তথ্যের ওপর নেওয়া সিদ্ধান্তও ভুল হবে এবং এর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ হবে। এ বিষয়ে মুমিনদের সতর্ক করে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমাদের কাছে কোনো ফাসিক (অপরিচিত ব্যক্তি বা অপরিচিত খবর) ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তখন তোমরা তা যাচাই-বাছাই করো (তথ্যানুসন্ধান ও সঠিক সূত্র সন্ধান করো), না হলে তোমরা (এ অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে) অজ্ঞতাবশত কারও প্রতি আক্রমণ করে বসবে (যা যথাযথ নয়), ফলে তোমরা পরে তোমাদের স্বীয় কর্মের জন্য লজ্জিত হতে হবে’ (৪৯: ৬)।
রটনাকারী মিথ্যাবাদী
সত্য-সুন্দর হলো ইসলাম, মিথ্যা হলো কুফর এবং জাহেলিয়াত বা মূর্খতা হলো অন্ধকার। মিথ্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে হাদিসে আছে, ‘মিথ্যা সব পাপের জননী’ (বুখারি)। স্বরচিত মিথ্যাকে ‘ইফতিরা’ বলা হয়। তথ্য যাচাই-বাছাই না করে অসত্য তথ্য বা ভুল সংবাদ প্রচার করাও মিথ্যার শামিল এবং প্রচারকারী ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিগণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনে (সত্যাসত্য যাচাই না করে) তাই বলতে বা প্রচার করতে থাকে’ (বুখারি)। কোনো মিথ্যাবাদী কখনো প্রকৃত মুমিন হতে পারে না।
বিবেকশূন্য পরিস্থিতি
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শপথ সেই মহান সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ। দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস হবে না (তার পূর্বে) মানুষের প্রতি এমন একসময় আসবে; হত্যাকারী জানবে না সে কেন হত্যা করছে আর নিহত ব্যক্তি জানবে না তাকে কেন হত্যা করা হয়েছে। বলা হলো: সেটা কীভাবে হবে? বললেন: হারাজ (গুজব, হুজুগ, অলীকতা, বিবেকহীনতা, মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা, অন্যায় হত্যা, বিচারহীনতা ও সত্য মিথ্যার মিশ্রণ ইত্যাদি) এর কারণে’ (মুসলিম: ৩৯০৮)। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের আগে ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, ভূমিকম্প বেশি হবে, সময় সংকীর্ণ হয়ে যাবে, ফিতনা প্রকাশ হবে, হত্যাকাণ্ড-খুনখারাবি বেড়ে যাবে, সম্পদের আধিক্য হবে’ (বুখারি: ১০৩৬)। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তখন কি মানুষের বুদ্ধি–বিবেক থাকবে না?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘না। সে সময় মানুষ বিবেকশূন্য হয়ে যাবে এবং মনে করবে সে-ই সঠিক, আসলে তা নয়’ (মুসনাদে আহমাদ: ৩২: ৪০৯)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কিয়ামতের আলামত হলো ‘হারাজ’! বলা হলো ‘হারাজ’ কী? তিনি বললেন, ‘মিথ্যা ও হত্যা। এই হত্যা হবে অজ্ঞতাপ্রসূত, স্বার্থপরতায় এবং খামখেয়ালিপনায়’ (ফাতহুলবারি-১৩: ৩৪)।
বিনা বিচারে শাস্তি ও হত্যা নিষিদ্ধ
আল্লাহ তাআলা কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘তোমরা ন্যায়বিচার ব্যতীত কোনো মানুষ হত্যা করবে না, যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন’ (৬: ১৫১)। তিনি আরও বলেন, ‘কোনো মুমিন কোনো মুমিনকে খুন করতে পারে না’ (৪: ৯২)। ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো বিশ্বাসী লোককে খুন করল, তার পরিণতি জাহান্নাম, তাতে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর গজব ও লানত আর আল্লাহ তার জন্য মহা শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন’ (৪: ৯৩)। ‘নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল, আর যে কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে প্রাণে রক্ষা করল’ (৫: ৩২)।
দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা এবং পরকালে জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য আমাদের জ্ঞানের অনুসরণ করতে হবে। বাছবিচার করে সত্যকে গ্রহণ করতে হবে। বিনা প্রমাণে কাউকে অভিযুক্ত করা কবিরা গুনাহ। আইন–আদালতের বাইরে কাউকে কোনো প্রকার শাস্তি প্রদান করা অপরাধ।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
৩টি স্থানে মিথ্যা বলা জায়েজ
আবু দাউদ শরীফের হাদীস নং ৪৯২১ এ হাদীসে দেখা যায় নবী করিম (দঃ) এরশাদ করেন ৩ স্থানে মিথ্যা বলা জায়েজ।
১। স্বামী তার স্ত্রীকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলা জায়েজ।
ওলামায়ে কেরাম এর ব্যাখ্যায় লিখেন যে স্ত্রীরা জিদ্দি হয়ে থাকে, এখন আপনি যদি স্ত্রী কোন কিছু আবদার করে আর আপনি তা না করার এরাদা করেন তখন যদি সাথে সাথে বলে দেন যে আপনি বউ এর সে আবদার পুরন করবেন না তখন বউ হতে পারে ঘরে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তাই এ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে ঠান্ডা রাখার জন্য আপনি বলে দিলেন ঠিক আছে করে দিব ইনশা আল্লাহ। স্ত্রী যদি বলে আমাকে আকাশের চাঁদটা এনে দাও তখনও আপনি বলতে পারেন ইনশাআল্লাহ আমি যত দ্রুত সম্ভব তোমার জন্য চাঁদ এনে দিব। অথচ এটা পসিবল না তবুও আপনি যেহেতু মজবুর, যদি মুখের উপর না বলে দেন তাহলে অনেক বড় ঝগড়ার কারন হতে পারে, তাই এ থেকে বাঁচার জন্য ইসলামী শরীয়ত এ ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার এজাজত দিয়েছে।
২। যুদ্ধ ময়দানে মিথ্যা বলা জায়েজ
এর ব্যাখ্যায় ওলামায়ে কেরাম বলেন আপনি যুদ্ধের ময়দানে গ্রেফতার হলেন তখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করল তোমরা কতজন সৈন্য? তখন আপনি সেখানে যুদ্ধ কৌশল হিসেবে সংখ্যা বেশী বলতে পারেন, যেমন নবী করিম (দঃ) ঘোষনা দিতেন আগামীকাল সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে সৈন্যদের নিয়ে পূর্ব দিকে রওয়ানা দিব কিন্তু দেখা যেত তিনি নামাজ শেষে পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিতেন। কারন রাতে নামাজে মুনাফিকরা থাকত তারা শত্রুদের সে খবর দিয়ে দিত তাই রসুলুল্লাহ (দঃ) যুদ্ধ কৌশল হিসেবে এমনটি করতেন।
৩। ২ জন লোকের মাঝে সন্ধি করতে ঝগড়া মিটাতে মিথ্যা বলা জায়েজ।
যেমন আপনার ২ প্রতিবেশী ঝগড়া করে একে অপরের মুখ পযন্ত দেখে না তখন আপনি একজন প্রতিবেশীকে গিয়ে বললেন যে তুমি ওর সাথে কথা বলনা অথচ দেখলাম সে তোমার খুব প্রসংশা করছে, তুমি যে তার অনেক ভাল প্রতিবেশী সেটা সে স্বিকার করেছে, কিন্তু এখন তুমি যে তার সাথে কথা বলছনা তাতে সে খুবই দুঃখীত। তারপর যখন ২য় প্রতিবেশীর সাথে দেখা হবে তাকেও একইভাবে বুঝালে দেখা যাবে একে অপরের সাথে আবার মিলে যাবে। এভাবে ২ জন লোকের মাঝে ঝগড়া মিটাতে মিথ্যা বলা শরীয়তে জায়েজ।
শরিয়তের দৃষ্টিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে?
ইসমাইল হোসেন
উত্তর : মিথ্যা বলা কোনো ক্ষেত্রেই অনুমোদিত নয়। শরিয়তে সত্যকে সর্বত্রই উৎসাহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সত্য মুক্তি দেয়, মিথ্যা ধ্বংস আনে। সামাজিক আচরণবিধি সম্পর্কিত মাসয়ালা পাওয়া যায় যে, বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং নির্দোষ ব্যক্তির প্রাণ রক্ষার লক্ষ্যে কখনো অপ্রিয় সত্যটি গোপন করা বা অসত্যকে তুলে ধরার অনুমতি রয়েছে। কোনো বৈধ বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে বা অধিকার সুরক্ষার জন্য দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট কথা বলার অনুমতি শরিয়তে রয়েছে। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে সত্য বলাই শরিয়তের মৌল দর্শনের দাবি।
সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।
উত্তর দিয়েছেন : আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী
যেসব ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজঃ
ইমাম নববী (রাহেমাহুল্লাহ)
বলেনঃ মিথ্যা বলা মুলতঃ হারাম; কিন্তু
কোন কোন ক্ষেত্রে কত গুলো শর্ত
সাপেক্ষে জায়েজ।
সংক্ষেপে টা হলঃ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই
মানুষকে কথা বলতে হয়। ভালো উদ্দেশ্য
যদি মিথ্যা বলা ছাড়া লাভ করা যায়
তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা হারাম;
কিন্তু যদি টা মিথ্যা বলা ছাড়া লাভ
করা না যায়,
তবে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজ।
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যদি মুবাহ বা জায়েয হয়
তাহলে সে ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাও জায়েয।
আর যদি টা ওয়াজিব হয়
তাহলে মিথ্যা বলাও ওয়াজিব। যেমনঃ কোন
হত্যাকারী জালেমের ভয়ে কোন মুসলমান
কোন ব্যক্তির কাছে পালিয়ে থাকে,
অথবা ধন-সম্পদ লুট হয়ে যাওয়ার
ভয়ে তা অন্যের কাছে সরিয়ে রাখে আর
জালেম যদি কারো কাছে জানার জন্য খোঁজ
নেয় তখন মিথ্যা বলা ওই ব্যক্তির জন্য
ওয়াজিব। এমনিভাবে কারো কাছে যদি কোন
আমানত গচ্ছিত থাকে আর জালেম
যদি তা ছিনিয়ে নিতে চায়, তা গোপন
করার জন্য মিথ্যা বলা ওয়াজিব।
কোনো মুসলমালনের সম্মান রক্ষার্থে মিথ্যা বলা ওয়জিব।
এসব ক্ষেত্রে রুপক ভাষার মাধ্যমে কাজ উদ্ধার
করতে চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে সে মিথ্যুক
হবে না যদিও শব্দগুলো বাহ্যত মিথ্যার
অর্থ প্রকাশ করে বা যাকে উদ্দেশ্য
করে বলা হচ্ছে তার দিক থেকে বিচার
করলে মিথ্যাই মনে হয়। আর
যদি চতুরতা পরিহার
করে সরাসরি মিথ্যা কথা বলা হয় তবুও
হারাম হবে না। এসব
ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা জায়েজ হওয়ার
ব্যাপারে আলেমগন উম্মে কুলসুম (রাঃ)
কর্তৃক বর্ণিত হাদিস প্রমান হিসেবে পেশ
করেছেন। হাদিসটি উল্লেখ
করা হলঃ তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)
বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দু'দলের
মধ্যে শান্তি স্থাপন
করতে ভালো কথা বানিয়ে বলে কিংবা কল্যাণের
কথা বলে সে মিথ্যুক নয়। (বুখারি ও
মুসলিম)
মুসলিমের বর্ণনায় আছে, উম্মে কুলসুম বলেম,
আমি তাঁকে কখনও মানুষকে চতুরতা অবলম্বন
করার অনুমতি দিতে শুনি নি।
তবে তিনটি ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছেনঃ যুদ্ধের
ব্যাপারে, মানুষের মাঝে বিবাদ
মিটিয়ে সন্ধি ও
শান্তি স্থাপনে এবং স্বামী স্ত্রীর
সাথে ও স্ত্রী স্বামীর সাথে কথোপকথনে।
(রিয়াজুস সালেহিন, পরিচ্ছেদঃ ২৬১)
উম্মু কুলসুম বিনতে ‘উকবাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন, সে ব্যক্তি মিথ্যাচারী নয়, যে মানুষের মধ্যে মীমাংশা করার জন্য (বানিয়ে) ভালো কথা পৌঁছে দেয় কিংবা ভালো কথা বলে। (মুসলিম ৪৫/২৭ হাঃ ২৬০৫, আহমাদ ২৭৩৪১) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২৪৯৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৫১০)
মুসলিমের এক বর্ণনায় বর্ধিত আকারে আছে, উম্মে কুলসুম (রঃ) বলেন, “আমি নবী (সঃ) কে কেবল মাত্র তিন অবস্থায় মিথ্যা বলার অনুমতি দিতে শুনেছিঃ যুদ্ধের ব্যাপারে, লোকের মধ্যে আপোষ মীগোশতা করার সময় এবং স্বামী স্ত্রী পরস্পরের (প্রেম) আলাপ আলোচনায়।’
Last Updated : 10:20 AM 16 March 2021