মাতৃ ভাষা ও একুশের চেতনা
Umarah Junnah Khan 21 February 2021 Last Updated : 11:41 AM 21 February 2021
আট ফাগুনের এই দিনটি এলেই রাইয়ানের কিশোর মন শিমুলরাঙা হয়ে ওঠে। আনন্দ নাকি আগুন রঙে দীপ্ত হয় কোমলমতি সে বালক ঠিক ঠাহর করা মুশকিল! ঘড়িতে রাত বারটা বাজার প্রতীক্ষায় নির্ঘুম বসে থাকে সে। তারপর প্রতীক্ষিত সে ক্ষণটি এলেই তার দাদুর লেখা প্রিয় ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বসে পড়ে পড়ার টেবিলে। তার দাদু মোহাম্মদ ইব্রাহিম, পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের একজন অকুণ্ঠ সমর্থকই শুধু ছিলেন না, বরং তৎকালীন বিভিন্ন ছাত্র সমাবেশ, মিছিল, মিটিংয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ জুগিয়েছিলেন। সেদিনের রক্তরঞ্জিত পিচঢালা পথে মায়ের ভাষা ছিনিয়ে নেবার সে নির্মম হত্যাযজ্ঞের দৃশ্যগুলো খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। ঘটনার আকষ্মিকতা অবলোকন পর রাইয়ানের দাদু মোহাম্মদ মতিয়ার রহমান এতটাই বিমর্ষ ও ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন যে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মায়ের ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও উপযুক্ত মর্যাদা দানের জন্য আমৃত্যু নিরবে কখনও সরবে কাজ করে গেছেন। ভাষা বিষয়ে লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কখনও কলামিস্ট হিসেবে কখনও প্রাবন্ধিক বা ছোট গল্পকার হিসেবে। আর এসব করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো সযত্নে তুলে রেখেছিলেন তার প্রিয় ডায়েরির পাতায়। রাইয়ান প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারির রাতে গভীর মনোযোগ দিয়ে ডায়েরির প্রতিটি লাইন পড়ে, বার বার পড়ে। দেশের প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় মমতায় বিগলিত হয় তার হৃদয়। সারারাত জেগে পড়তে থাকে প্রিয় দাদুর সংগ্রামী সেসব গল্প। ঠিক তখনই যেন ওর দাদু এসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে," দাদুভাই, যুদ্ধ কিন্তু এখনও শেষ হয় নি। আজ সারা পৃথিবীতে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদার কাহিনী সুবিদিত হয়েছে বটে কিন্তু এখনও তোমরা নিজ ভাষা সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে ধার করা ভাষা সংস্কৃতির পিছনে ছুটছো। দাদুভাই, এ বড় লজ্জার! এ বড় কষ্টের! নিজের ভাষার হারানো গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে আবার সংগ্রাম করো দাদুভাই।" রাইয়ান অস্পষ্ট বাক্যে একাকী বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে- হ্যাঁ দাদুভাই, আমি তোমার আদর্শের পথেই চলব, নিজের ভাষাকে সবার উপরে মর্যাদা দেবো। ভাষা মহান আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত। তার উপযুক্ত সম্মান প্রতিষ্ঠা করব। মায়ের ভাষাকে বুকের রক্ত দিয়ে যারা অধিষ্ঠিত করে গেছেন তাদের আদর্শকে বুকে লালন করে আমিও আজীবন বাংলা ভাষাকে ভালোবাসব। বড় হয়ে নিজের পরিবার এমনকি দেশে-বিদেশে মাতৃভাষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করব। দাদুভাই, তুমি দেখো, আমিও তোমার পথে চলব। তোমার অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ। এভাবে একাকী বিড়বিড় করতে করতে রাইয়ান প্রায় রাত শেষ প্রহরে এসে পৌঁছে । একসময় সুবহে সাদিকে মসজিদের মিনারে ধ্বনিত হয় আসসালাতু খাইরুম মিনান না'উম...
সালাত শেষে রাইয়ান বেরিয়ে পড়ে পিচঢালা পথে। সবাই ফুল হাতে প্রভাত ফেরিতে যাচ্ছিল। রাইয়ান তাদের সাথে ক্ষণিকের সঙ্গী হয় না। কেবল দূর থেকে সবিস্ময়ে স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে দেখে প্রভাতের শহীদ মিনার। মিনার অর্থ কি তা জানে রাইয়ান। তাইতো শহীদ মিনার পদে পড়ে থাকা ফুলগুলো তাকে বিশেষ আনন্দ দেয় না । যে তাজা ফুলগুলো ক্ষাণিক বাদেই শুকিয়ে যাবে, ঝেড়ে মুছে ফেলা হবে মিনারের বেদী প্রাঙ্গণ, তার কী এমন বিশেষত্ব! রাইয়ান বরং শিমুল-পলাশ বৃক্ষপানে ফিরে তাকায়। তার দুচোখে তখন আগুন ঝরে- জলের ফোঁটা বিন্দুসম। আর সে বার বার মাতৃভাষার সম্মান প্রদানে এভাবেই দৃঢ় প্রত্যয়ী হয় ফেব্রুয়ারির প্রতি একুশ সকালে।
Last Updated : 11:41 AM 21 February 2021